ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন :- বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলায় অবস্থিতি প্রায় ১শ’ বছরের পুরোনো ব্রিটিশ আমলে নির্মিত রেলওয়ে জংশন স্টেশন ও ইয়ার্ড’। এটি বাংলাদেশের প্রাচীন এবং বৃহত্তম রেল স্টেশন এবং জংশন। ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন ঈশ্বরদী পৌরসভা সদরে অবস্থিত।
ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন ঈশ্বরদী পৌরসভা সদরে অবস্থিত। ১৮৭৮ সালে, কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি রেলপথটি দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথম ভাগটি ছিল পূর্ববঙ্গ রাজ্যের রেলপথ ধরে কলকাতা স্টেশন (বর্তমানে শিয়ালদহ) থেকে পদ্মা নদীর দক্ষিণ তীরের দামুকদিয়া ঘাট পর্যন্ত ১৮৫ কিমির পথযাত্রা, তারপর ফেরিতে করে নদীর পেরিয়ে দ্বিতীয় যাত্রা শুরু হত।
উত্তরবঙ্গ রেলপথের ৩৩৬ কিলোমিটার মিটার গেজ লাইনটি পদ্মার উত্তর তীরের সারাঘাটকে শিলিগুড়ির সাথে সংযুক্ত করেছিল। এই সময়কালেই ঈশ্বরদী রেলস্টেশন হিসাবে তৈরি হয।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজটি নির্মাণাধীন থাকার সময়, শাকোল-সান্তাহার ভাগটি ১৯১০-১৯১৪ সালের মধ্যে ব্রডগেজে রূপান্তরিত হয়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজটি ১৯১৫ সালে চালু হয়। সেতুটি চালুর পর উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন স্থাপিত হয়।
২ কিলোমিটার দীর্ঘ ইয়ার্ড ও স্টেশনটিতে ১৭টি রেললাইন স্থাপন করা হয়। ১৯৯৯ সালে ৪.৮ কিলোমিটার (৩ মাইল) দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের ফলস্বরূপ, রেলের প্রয়োজনীয়তা পুনর্নির্ধারণ করা হয়।




প্লাটফর্ম (ছবি:- উজ্জল হোসেন)
প্রথমত, রেলওয়ে ব্যবস্থার পূর্ব অংশটি পশ্চিমাঞ্চলের সাথে সংযুক্ত করার জন্য জয়দেবপুর থেকে জামতৈল পর্যন্ত ৯৯ কিলোমিটার (৬২ মাইল) দীর্ঘ নতুন ডুয়েলগেজ লাইন তৈরি করা হয়ে। দেশের দুটি অংশে দুটি ভিন্ন গেজের সমস্যাটি দ্বৈত গেজ প্রবর্তন করে সমাধান করা হয়। দ্বিতীয়ত, জামতৈল থেকে পার্বতপুর পর্যন্ত ২৪৫ কিলোমিটার (১৫২ মাইল) দৈর্ঘ্যের ব্রডগেজ ট্র্যাকটি দ্বৈত গেজে রূপান্তরিত করা হয়।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ:- ঈশ্বরদী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে, পাকশী রেল-স্টেশন সংলগ্ন পদ্মা নদীর তীর এবং কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারার পদ্মার তীরের মধ্যবর্তী একটি রেলসেতু। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ রেলসেতু হিসেবে পরিচিত।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজকে ঘিরে ঈশ্বরদীর পাকশী দেশের একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত। এটির নামকরণ করা হয় লর্ড হার্ডিঞ্জের নামে। ১৯১০ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতবর্ষের ভাইসরয় ছিলেন। দুই দশক পূর্বে প্রস্তাব করা হলেও এটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯১০ সালে আর শেষ হয় ১৯১২ সালে। ১৯১৫ সাল থেকে এই ব্রিজে ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
অবিভক্ত ভারত সরকার আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ সহজ করতে এই ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ১৯১৫ সালের ৪ মার্চ লর্ড হার্ডিঞ্জ ব্রিজটি উদ্বোধন করেন। ব্রিজটি নির্মাণে ব্যয় হয় ৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা (৩ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার ১৬৪ রুপি)। এই ব্রিজটি নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল বাংলার পূর্ব অংশের সাথে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করা।
ব্রিজটি অপূর্ব সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে নির্মাণ করাতে ব্রিটিশ ইন চিফ ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট উইলিয়াম গেইলস’কে তার সাফল্যের পুরস্কার স্বরূপ স্যার উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৫টি স্প্যানের এই ব্রিজের দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৯৪০ ফুট। ব্রিজ দিয়ে শুধু ট্রেন চলাচলের জন্য পাশাপাশি দুটি ব্রডগেজ রেললাইন রয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে ব্রিজ রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে।
ব্রিটিশ সরকারের নির্মিত এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজের খ্যাতি নানান কারণেই অতুলনীয়। যদিও বর্তমানে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের চেয়েও লম্বা অনেক সেতু আছে, তবে কিছু কিছু কারণে এই ব্রিজটি তর্কাতীত বিখ্যাত। তার কারণ হচ্ছে এই ব্রিজের ভিত গভীরতম পানির সর্বনিম্ন সীমা থেকে ১৬০ ফুট বা ১৯২ এমএসএল মাটির নিচে। এর মধ্যে ১৫ নম্বর স্তম্ভের কুয়া স্থাপিত হয়েছে পানির নিম্নসীমা থেকে ১৫৯ দশমিক ৬০ ফুট নিচে এবং সর্বোচ্চ সীমা থেকে ১৯০ দশমিক ৬০ ফুট অর্থাৎ সমুদ্রের গড় উচ্চতা থেকে ১৪০ ফুট নীচে। সে সময় পৃথিবীজুড়ে এই ধরনের ভিত্তির মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে গভীরতম।
বর্তমানে এবছর ২০২০ সালে ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংসন স্টেশনটি নতুনরুপে সংস্কারের কাজ চালু করা হয়।
পূর্বের প্লাটফর্মের উচ্চতার চেয়ে ২১’ বেশি উচ্চতায় উন্নীত করা হয়। যার ফলে যাত্রীদের উঠানামায় ব্যাপক সহজলভ্য ও সমান্তরাল আনা হয়েছে।
প্রায় হাফ কিমি দীর্ঘ নতুন প্লাটফর্ম সংযোগ করা হয়।
এতে করে ঈশ্বরদী রেলওয়ে স্টেশনটির সৌন্দর্যের নতুনরুপ নিয়েছে।




হার্ডিঞ্জ ব্রিজে সৌদর্য্য উপভোগ: হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে ও পদ্মার পাড়ে বিকেল বেলাটা খুবই মনোরম কাটবে আপনার । চাইলে নৌকা নিয়েও পদ্মায় ঘুরতে পারেন। অনেক দূর–দূরান্ত থেকে মানুষ আসে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের আশেপাশে ঘুরতে। ছুটির দিনে এবং যেকোনো উৎসবে ভ্রমণপ্রিয় মানুষরা এখানে ঘুরতে আসেন। এখানে এলে আপনি হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশাপাশি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম লালন শাহ সেতুও দেখতে পাবেন। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, লালন শাহ সেতু আর পদ্মার দু’পাড়ের সবুজে ঘেরা মনোরম সৌন্দর্য এখানে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছ।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজের আশপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঘিরে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট। ব্রিজের নিচেও গড়ে উঠেছে বেশ কিছু অস্থায়ী দোকান। লালন শাহ সেতু নির্মাণের আগে হার্ডিঞ্জ ব্রিজেরে একপাশে মানুষের হেঁটে পারাপারের ব্যবস্থা ছিল। এখন সেই পথটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পাকশীর দিকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজে ওঠার সিঁড়ির কাছে ব্রিজটি সম্পর্কে তথ্য বিবরণী দেখতে পাবেন।
যেভাবে আসবেন :ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের সকল জেলা ও শহর থেকে যমুনা সেতুর মাধ্যমে সড়কপথে সরাসরি পাবনা যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে যমুনা সেতু হয়ে পাবনা যেতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগবে। এরপর ঈশ্বরদী রেলওয়ে স্টেশন অথবা ঈশ্বরদী বাসস্ট্যান্ড হতে রিকশা, সিএনজি অথবা টেম্পু দিয়ে পাকশী রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যেতে পারবেন।
যেখানে থাকবেন : পাবনা শহরে থাকার জন্য নানান মানের হোটেল রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল হোটেল প্রবাসী ইন্টার ন্যাশনাল, হোটেল পার্ক, হোটেল শিলটন, ছায়ানীড় হোটেল, প্রাইম গেস্ট হাউস, মিড নাইট মুন চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, স্বাগতম হোটেল এন্ড চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি।




উল্লেখ্য যে, রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের নতুন রেললাইন সংযোগের কাজ ও ট্রেন চলাচল এই স্টেশনের উপর দিয়ে শুরু হয়েছে, যা চলমান রয়েছে।
ঈশ্বরদী রেলওয়ে স্টেশন উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিনবঙ্গের গুরুত্যপূর্ন রেল যোগাযোগ হওয়ায় দিন রাত সবসময় বিভিন্ন ট্রেন চলাচল করছে।
উল্লেখযোগ্য চলাচল কারী কিছু ট্রেন হলো – রূপসা এক্সপ্রেস,সীমান্ত এক্সপ্রেস, কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস, মধুমতি এক্সপ্রেস, সাগরদাঁড়ি এক্সপ্রেস, সুন্দরবন এক্সপ্রেস, চিত্রা এক্সপ্রেস, মৈত্রী এক্সপ্রেস, বেনাপোল এক্সপ্রেস, মহানন্দা এক্সপ্রেস, রকেট এক্সপ্রেস, রাজশাহী কমিউটার, রাজশাহী এক্সপ্রেস, ঢালারচর সাটল ট্রেন, ঢাকা কমিউটার ও কিছু লোকাল ট্রেন।
লেখক:- মো উজ্জল হোসেন, সাংবাদিক ও সমাজ সেবক, ঈশ্বরদী, পাবনা।