নোট-গাইড বই প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে সম্প্রতি ‘শিক্ষা আইন-২০২০-এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে শর্তসাপেক্ষে ‘সহায়ক বই’ প্রকাশ ও বাজারজাতকরণের সুযোগও রাখা হয়েছে আইনে। আবার শিক্ষকদের প্রাইভেট-টিউশনির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে শর্তসাপেক্ষে অর্থাৎ নিবন্ধনের মাধ্যমে ‘ফ্রিল্যান্স কোচিং’ পরিচালনার সুযোগ রাখা হয়েছে খসড়ায়। আগামী এপ্রিলের মধ্যে শিক্ষা আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার (১৬ মার্চ) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাকিব উদ্দিন।
প্রাতিবেদনে আরও জানা যায়, এছাড়া খসড়া আইনে বলা হয়েছে, সরকারের অনুমোদন ছাড়া পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু এবং এর আলোকে বিভিন্ন প্রশ্নাবলীর উত্তর দৈনিক পত্রিকায় বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না।
শিক্ষানীতি ২০১০-এর আলোকেই ২০১১ সাল থেকেই একটি ‘শিক্ষা আইন’ প্রণয়নের চেষ্টা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু নোট-গাইড বই, কিংবা এর আদলে ‘সহায়ক বই’ ছাপার অনুমোদনের সুযোগ রাখা, না রাখা নিয়ে বারবার বিতর্কের মুখে পড়ছে শিক্ষা প্রশাসন। একইভাবে কোচিং সেন্টারের অনুমোদনের সুযোগ রাখা, না রাখা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। কারণ শিক্ষাবিদরা ‘সহায়ক বই’ ও কোচিংয়ের বিরোধিতা করে আসলেও ওই দুটি গোষ্ঠীর আন্দোলন ও নানা প্রচেষ্টার মুখে বারবার দুর্বল হচ্ছে আইনের খসড়া।
২০১১ সাল থেকে বেশ কয়েকবার অংশীজনদের মতামত নেয়ার পর শিক্ষা আইনের খসড়া তৈরি হয় এবং দু’বার মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হলেও নানা অসঙ্গতিতে তা ফিরিয়ে দেয়া হয়। নোট-গাইড বই ও কোচিং ব্যবসায়ীরা এই আইনের বাস্তবায়ন ঠেকাতে নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে আসছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
জানতে চাইলে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির বলেন, ‘শিক্ষানীতিতে নোট-গাইড বা এর বিকল্প ‘সহায়ক বই’ এবং কোচিং সেন্টার-এই ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু এখন দেখছি, আইনে নিবন্ধনের সুযোগ রেখে, এগুলোকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে। এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’
নিবন্ধনের মাধ্যমে কোচিং সেন্টার পরিচালনার সুযোগ দেয়া হলে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের আরও প্রসার ঘটবে মন্তব্য করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘এর মাধ্যমে মূলত কোচিং সেন্টারগুলো শিক্ষা বাণিজ্যের জন্য সরকারের লাইসেন্স পাবে, বৈধতা পাবে। যারা নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকবেন, তারাও দেনদরবারের মাধ্যমে লাভবান হবেন।’
সহায়ক বই অনুমোদন প্রক্রিয়ার বিষয়ে অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির বলেন, ‘যাহা সহায়ক বই, তাহাই নোট-গাইড। সামান্য পার্থক্য রয়েছে, তা হলো- নোট-গাইডে হুবহু সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া থাকে, আর সহায়ক বইয়ে অনেকগুলো উত্তর দেয়া থাকে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন থাকে, সহায়ক বইয়ের প্রয়োজন কেন? আমাদের শিক্ষকরা কী পড়াতে পারছেন না? না পারলে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হোক। আর সহায়ক বই কারা লিখছেন….সরকারের শিক্ষকদের টাকা দিয়েই তো তা লেখা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বলা হচ্ছে, সহায়ক বইয়ের অনুমোদন দেবে এনসিটিবি ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’। এই প্রতিষ্ঠানের কাজই হলো-শিক্ষাক্রম আধুনিকায়ন, নতুন শিক্ষাক্রম তৈরি। এসব বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে এনসিটিবিকে অপ্রয়োজনীয় ও বাণিজ্যিক কাজে লাগানো হচ্ছে কেন?’
শিক্ষানীতিতে যা আছে
‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর মুখবন্ধে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, ‘পরীক্ষা পদ্ধতি বা শিক্ষার্থীর শিক্ষার মান যাচাই বা শিক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতির মৌলিক পরিবর্তন করতে হবে। এজন্য ক্লাশরুমের শিক্ষাকে সম্পূর্ণ সফল করতে হবে। শিক্ষার্থীদের তথাকথিত নোট বই, প্রাইভেট টিউশনি প্রভৃতি অনাকাক্সিক্ষত আপদ থেকে মুক্তি দিতে হবে।’
নোট-গাইডের সংজ্ঞা
খসড়ায় নোট-গাইড বই অর্থে বোঝানো হয়েছে, ‘সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সহায়ক পুস্তক ব্যতীত যে পাঠ্যপুস্তকসমূহে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু ও এর আলোকে বিভিন্ন পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নাবলীর উত্তর লিপিবদ্ধ থাকে, যাহা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রয় হয়।’
সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে সহায়ক পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ প্রকাশ ও বাজারজাত করা যাবে-উল্লেখ করে খসড়া শিক্ষা আইনে বলা হয়েছে, ‘তবে এই বই ক্রয়ে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা যাবে না। উৎসাহ প্রদানও করা যাবে না। এ অভিযোগে কেউ অভিযুক্ত হলে সরকার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে।
প্রাইভেট টিউশন কী
প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিংয়ের বিষয়ে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে বলা হয়েছে, কোন শিক্ষক নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট টিউশনের মাধ্যমে পাঠদান করতে পারবেন না। তবে শর্ত থাকে যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
শিক্ষকরা নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষার্থীকে অর্থের বিনিময়ে ইলেকট্রনিকস বা অনলাইন পদ্ধতিতেও টিউশন বা কোচিংয়ের মাধ্যমে পাঠদান করতে পারবেন না এবং করলে তা অসদাচরণ গণ্যে শাস্তিযোগ্য হবে।
খসড়া আইনে প্রাইভেট-টিউশন অর্থ- ‘কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্তৃক অর্থের বিনিময়ে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষার্থীকে যেকোন স্থানে পাঠদান করা’।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষ নির্ধারিত আইন দ্বারা নিবন্ধন ব্যতিরেকে কোচিং সেন্টার পরিচালনা করা যাবে না। একই কোচিং সেন্টারে দেশি শিক্ষাক্রম ও বিদেশি শিক্ষাক্রমের পাঠদান পরিচালনা করা যাবে না। এই ধারা লঙ্ঘন করলে অনূর্ধ্ব তিন বছর কারাদ- বা অনূর্ধ্ব-১০ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ডে দন্ডণীয় হবে।
সহায়ক বই ও কোচিং সেন্টারের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর তাসলিমা বেগম বলেন, ‘সহায়ক বই যদি চলতে পারে, তাহলে নোট-গাইড বই কেন নয়? এগুলোর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এগুলো শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে। মূল কথা-পাঠ্যবইয়ের বাইরে কোন বইয়েরই প্রয়োজন নেই। সর্ম্পূণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সহায়ক বই ও কোচিং চলছে।’
অর্থের লোভে শিক্ষকরা ক্লাসরুমে না পড়িয়ে সহায়ক বইয়ের তালিকা ছাত্রছাত্রীদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে-মন্তব্য করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) প্রশিক্ষণ শাখার সাবেক এই পরিচালক বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন শিক্ষক প্রশিক্ষণের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। লাখ লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আমি মনে করি, ক্লাসরুমের টিচিং ইফেক্টিভ করতে পারলে, স্ট্রং মনিটরিং করতে পারলে সহায়ক বা নোট-গাইড বই ও কোচিং সেন্টারের কোন প্রয়োজন নেই।’
শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির কাছে দিয়েছেন জানিয়ে প্রফেসর তাসলিমা বেগম বলেন, ‘দেশের প্রায় ৯০ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বেসরকারি ও এমপিওভুক্ত। অথচ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোয়ালিটি শিক্ষক নিয়োগের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা নেই। ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিতে না পারলে সহায়ক বই ও কোচিং সেন্টারের ব্যবসা চলবেই।’
শিক্ষক নিয়োগের জন্য ‘সরকারি কর্মকমিশনের’ (পিএসসি) আদলে তিনি একটি সাংবিধানিক ‘প্রতিষ্ঠান’ প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন।
প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষ নিয়োগ সম্পর্কে যা বলা আছে
সরকার এমপিও এবং নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক এবং অধ্যক্ষ তিন বছরের জন্য নিয়োগ দিতে পারবে- এমন বিধান শিক্ষা আইনের খসড়ায় রাখা হয়েছে। একই প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকবে।
টিউশন ফি’র বিষয়ে আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষারস্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি, অন্য ফি সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। অনুমোদন ব্যতীত কোন ফি নেয়া যাবে না।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি দেয়া যাবে না-উল্লেখ করে খসড়ায় বলা হয়েছে, তবে শিক্ষার্থীর মঙ্গলের জন্য শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীকে যৌক্তিকভাবে শাসন করা যাবে। এই ধরনের শাসনের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে শিক্ষক দায়ী হবেন না।
বিদ্যমান আইনে যা আছে
জানা গেছে, ১৯৮০ সালে নোট বই প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে একটি আইন করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নোট বই ছাপা ও বাজারজাতকরণ বন্ধের উদ্যোগ নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর সরকারের অননুমোদিত নিম্নমানের বই, নোট ও গাইড বই বাজারজাত বন্ধ করতে প্রয়োজনে মোবাইলকোর্টের সাহায্য নিতে ডিসিদের নির্দেশ দেয়া হয়। এ নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রয় সমিতির তৎকালীন সভাপতি আবু তাহের ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন।
রিট আবেদনে বলা হয়, নোট বই নয়, গাইড বই প্রকাশ করে তা বাজারজাত করা হচ্ছে। কিন্তু রিট আবেদনকারীর যুক্তি খ-ন করে উচ্চ আদালত ওই বছরের ১৩ মার্চ ১৯৮০ সালের নোট বই নিষিদ্ধকরণ আইনের আওতায় নোট বইয়ের সঙ্গে গাইড বইও বাজারজাত ও বিক্রি নিষিদ্ধ করে মন্ত্রণালয়ের আদেশ বহাল রাখেন।
পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের রায়ের পর রিট আবেদনকারী আপিল করবেন উল্লেখ করে ওই আদেশ স্থগিত করতে আপিল বিভাগে আবেদন করেন। আপিল বিভাগ ওই আবেদন খারিজ করে দেন।
পরে ২০০৯ সালের নভেম্বরে নোট-গাইড বই নিষিদ্ধ করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আবু তাহের। তখন আপিল বিভাগের চেম্বার জজ উচ্চ আদালতের আদেশ স্থগিত করেন। এতে পুনরায় নোট ও গাইড বই বাজারজাত শুরু হয়। এ অবস্থায় অ্যাটর্নি জেনারেলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের নভেম্বরে আপিল বিভাগ বিষয়টির ওপর শুনানি গ্রহণ করেন।
শুনানি শেষে আপিলও খারিজ করে দেয় আদালত। ফলে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকের নোট-গাইড, নিম্নমানের বই মুদ্রণ, প্রকাশনা, বিক্রি ও বিতরণ করার উদ্দেশে মজুদ রাখা অবৈধ। এরপরই নোট ও গাইড বইয়ের নাম বাদ দিয়ে ‘সহায়ক বই’ নামে এই ব্যবসা অব্যাহত রয়েছে।