জাতীয় সংসদ ভবন, ঢাকা।
আমেরিকার স্থপতি লুই আই কান-এর সৃষ্টিশীল ও কাব্যিক প্রকাশের এক অনন্য নিদর্শন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন।
রাজধানী ঢাকার শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত জাতীয় সংসদ ভবন কেবল একটি অসাধারণ নির্মাণ শৈলীর নিদর্শনই নয় বরং এটি এমন স্থাপত্য যার জন্য পুরো জাতি গর্বিত। পিরামিডের সময় থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত তৈরি স্থাপত্যসমূহের যদি একটি বাছাই তালিকা করা হয় তবে তাঁর মাঝেও বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন উপরের সারিতেই স্থান পাবে।এটি আধুনিক যুগের স্থাপত্য রীতির সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন গুলোর মধ্যে অন্যতম। অসাধারণ এই ভবনটি আমেরিকার স্থপতি লুই আই কান-এর সৃষ্টিশীল ও কাব্যিক প্রকাশের এক অনন্য নিদর্শন। ১৯৫৯ সালে প্রথম ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবন কমপ্লেক্সটি তৈরির পরিকল্পনা গৃহীত হয়।
তৎকালীন সামরিক সরকার পাকিস্তানের প্রস্তাবিত দ্বিতীয় রাজধানী শেরে বাংলা নগরে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সংসদ ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে বর্তমান সংসদ ভবনটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তখনকার খ্যাতনামা স্থপতি লুই কান ভবন কমপ্লেক্সটির নকশা প্রণয়নের জন্য প্রাথমিক ভাবে নির্বাচিত হন। তাঁকে সরাসরি কাজে নিযুক্ত না করে ভবনের প্রাথমিক নকশা প্রদানের জন্য বলা হয়। ১৯৬২ সালের মার্চ মাসে তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে এটি তৈরির দায়িত্ব পান।
১৯৬১ সালে বর্তমান মানিক মিয়া এভিনিউ-এর উত্তর পার্শ্বে ২০৮ একর জমি দ্বিতীয় রাজধানী প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয় এবং ১৯৬২ সালেই এর মূল নকশা ও প্রস্তুত হয়। ১৯৬৪ সালে ১৫ মিলিয়ন ডলারের অনুমিত ব্যয় ধরে কমপ্লেক্সটির নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নির্মাণাধীন প্রধান অবকাঠামোটির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার ভবনের মূল নকশায় কোনো রকম পরিবর্তন না এনে নির্মাণ সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সমস্ত সুবিধাদিসহ ৩২ মিলিয়ন ডলারের পরিবর্তিত ব্যয়ে সংসদ কমপ্লেক্সটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৮২ সালে। কমপ্লেক্সটির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে মূল সংসদ ভবন, সংসদ সদস্য, মিনিস্টার ও সেক্রেটারিদের হোস্টেল, অতিথি ভবন ও কমিউনিটি বিল্ডিং। আশে পাশের রাস্তা, হাটার পথ, বাগান ও লেক দ্বারা এ ভবনকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে।
জাতীয় সংসদ ভবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর বিশালত্ব। মার্বেল পাথর সংযুক্ত বিপুল কংক্রিটের বহির্দেয়ালের মাঝে মাঝে রয়েছে নিখুঁত জ্যামিতিক আকৃতির প্রবেশদ্বার। বৃত্তাকার ও আয়তাকার কংক্রিটের সমাহার ভবনটিকে দিয়েছে এক বিশেষ স্থাপত্যিক সৌন্দর্য । ভবনের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে হলো সংসদের প্রধান হল যেখানে সংসদ সদস্যগণ পার্লামেন্টে বসেন। সমকেন্দ্রিক নকশার মূল হলরুমকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অংশগুলি গড়ে উঠেছে। ছাদ দিয়ে প্রবেশ করা আলোর মালা সাত তলা উঁচু গোলাকার মূল হলরুমটি এমনভাবে বেষ্টিত ঠিক যেন দেবীর মঞ্চকে ঘিরে উন্মুক্ত গোলাকার পথ। মূল ভবনের চার বাহু বরাবর চার কোণে অন্যান্য কাজের জন্য রয়েছে চারটি একই ধরনের অফিস ব্লক। যোগাযোগের জন্য রয়েছে বিভিন্ন প্রকার সিড়ির ব্যবস্থা। বর্গাকার নকশার হলেও এটি নিপুণ ভাবে অষ্টভুজের মধ্য স্থাপিত হয়েছে।
বিশিষ্ট হলেও অনুভূমিক যোগাযোগ রয়েছে মাত্র তিনটি তলায়। মাটির উপরে কাঠামোটির উচ্চতা ৪৯.৬৮ মিটার। মূল ভবন কমপ্লেক্সটির নয়টি স্বতন্ত্র বিভাগে বিভক্ত। এর মধ্য আটটি ৩৩.৫৩ মিটার এবং কেন্দ্রীয় অষ্টভুজাকার ব্লকটি ৪৭.২৪ মিটার উঁচু। কেন্দ্রীয় ব্লকটি ৩৫৪ আসন ধারণক্ষম অ্যাসেম্বলি কক্ষ নিয়ে গঠিত। সমগ্র কমপ্লেক্সটির আয়তন ৭৪,৪৫৯.২০ বর্গমিটার, দক্ষিণ প্লাজায় ২০,৭১৭.৩৮ বর্গমিটার এবং উত্তর প্লাজায় ৬,০৩৮.৭০ বর্গমিটার। দক্ষিণ প্লাজার মূল প্রবেশ পথটি একটি প্রশস্ত সিঁড়ির আকারে ধীরে ধীরে ৬.২৫ মিটার উচ্চতায় উঠে গেছে। এর বেসমেন্টে রয়েছে পার্কিং এলাকা, তত্ত্বাবধায়ক এজেন্সির অফিস ও মূল ভবনের সুবিধাদি প্রদানের জন্য স্থাপিত বিভিন্ন ব্যবস্থা। একটি কৃত্রিম লেক ভবনের চার পাশের প্রাচীর ঘিরে আছে এবং এটি উত্তর ও দক্ষিণ প্লাজাকেও সংযুক্ত করেছে। সমস্ত ভবনটাকে মনে হয় যেন পানির উপরে ভেসে উঠেছে।
পার্লামেন্ট ভবনে প্রবেশের জন্য রয়েছে দক্ষিণের গ্র্যান্ড প্লাজা ও উত্তরে সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত বাগান ও ইউক্যালিপটাসের সারি শোভিত প্রেসিডেন্সিয়াল স্কয়ার। উত্তর প্রবেশ পথের দিকে রয়েছে একটি এ্যাম্পি থিয়েটার যেখানে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এই ভবনের কোথাও কোনো কলাম নেই। শূন্য স্থানের অংশ হিসেবে ফাঁপা কলাম রয়েছে ঠিকই কিন্তু তা শুধুই কাঠামো নকশায় ভারসাম্য রক্ষার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি অনেকটাই বিশাল কংক্রিটকে খোদাই করে পরিণত করা হয়েছে একটি অসাধারণ কার্যকর ভাস্কর্যে। নির্মাণ মসলা হিসেবে কংক্রিট ব্যবহৃত হয়েছে এবং ভেতরে ও বাইরের অংশে ব্যবহৃত হয়েছে ঢালাই কংক্রিট। যে দক্ষতার সাথে আলোকে প্রয়োগ করা হয়েছে তাই হলো কান-এর নকশার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ছাদ দিয়ে প্রবেশ কৃত আলো বিভিন্ন জায়গাকে যেভাবে আলোকিত করেছে তাতে মনে হয় যেন আলোকচ্ছটা ঝরে পড়ছে স্বর্গ থেকে।
জাতীয় সংসদ ভবনের নকশায় সূর্যের আলো এবং বৃষ্টির প্রতিরোধকে বিবেচনা করা হয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে। অন্যদিকে বাতাসের বাধাহীন চলাচলকে সম্ভব করেছে বহিস্থ প্রাসাদের বিশাল জ্যামিতিক ত্রিভুজ, আয়তক্ষেত্র, সম্পূর্ণ বৃত্ত ও বৃত্তাংশ এবং সমতল খিলানসমূহ। ভবন কাঠামোটি একটি অসাধারণ সৌধ হিসেবে দৃষ্টিগোচর হয়। এখানে বাইরের দিকে গতাণুগতিকভাবে জানালা স্থাপন পদ্ধতিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং মূল দেওয়ালে ফাঁক সৃষ্টি করে বিশাল স্থাপত্যের অসুবিধাকে দূর করা হয়েছে। স্থাপত্যিক শৈলীতে ভবনটি ঢাকার আধুনিক ভবনসমূহ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ১৯৮২ সালের প্রথম দিকে ভবনটির কাজ সম্পন্ন হয় এবং একই বছর ২৮ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট জাস্টিস আব্দুস সাত্তার এটির উদ্বোধন করেন। ১৯৮২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এ ভবনে জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর প্রায় সকল স্থাপত্য বিষয়ক পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন আলোচিত হয়েছে এবং এটি আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।
লেখকঃ- মীর মাইনুল ইসলাম। ছবিঃ ট্রাভেল বাংলাদেশ