বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশের সার্বজনীন উৎসব। গত কয় বছরে জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে এটা । এ সময় নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আয়োজনে মেতে ওঠে সারা দেশ। বর্ণিল, আলোঝলমলে, হইচইয়ে ভরা কাউন্টডাউন আর আতশবাজিতে উদ্দাম আনন্দ উদযাপনের দৃশ্য ফুটে উঠে সারাদেশে। পান্তাভাত, বৈশাখী মেলা, খেলাধুলা, খাবার দাবার, নাচ-গান ও ঘুরে বেড়ানো – আরো কত্তো কী !
ঢাকা শহরে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা ও ব্যাপক উৎসবের আমেজে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়ে থাকে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।
পাকিস্তান শাসনামলে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে।
সারাদেশে একই নিয়মে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে নববর্ষ উদযাপন হয় ভিন্ন আবহে, একেবারে ভিন্ন মাত্রায় ও স্বাদে। দেশবিদেশের অনেকেই এখান নববর্ষ উদযাপনের জন্য মুখিয়ে থাকেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় ১৯৮৫ সাল থেকে
চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের সম্মিলিত উদ্যোগে বৈসাবি উৎসব পালন হয়ে আসছে । এ উৎসবটি ত্রিপুরাদের কাছে বৈসুক, বৈসু বা বাইসু , মারমাদের কাছে সাংগ্রাই এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে বিজু নামে পরিচিত।
বৈসাবী নামকরন করা হয়েছে এই তিনটি সম্প্রদায়ের উৎসবের প্রথম অক্ষরগুলো দিয়ে। বৈ শব্দটি ত্রিপুরাদের বৈসু থেকে, সা শব্দটি মারমাদের সাংগ্রাই থেকে এবং বি শব্দটি চাকমাদের বিজু থেকে। এই তিন শব্দের সম্মিলিত রূপ হলো ‘বৈসাবি’। তবে পাহাড়ের মানুষ বৈসাবি শব্দটি নিয়ে বিতর্ক তুলেছেন। তাঁরা বলছেন, বৈসাবি শব্দটি দিয়ে পাহাড়ের শুধু তিনটি সম্প্রদায়ের উৎসবকে বোঝায়। এরা হলো চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা। ফলে বাকি অন্য সম্প্রদায়ের লোকজনের উৎসবের কথা বাদ পড়ে যাচ্ছে।
ত্রিপুরাদের বর্ষবরণ উৎসবের নাম বৈসু। বৈসু উৎসব এদের জীবনের সবচেয়ে বড় উৎসব। বৈসু উৎসব একটানা তিন দিন পালন করা হয়। এই তিন দিনের অনুষ্ঠানগুলির নাম হলো হারি বৈসু, বিসুমা বৈসু ও বিসিকাতাল বা আতাদাং বৈসু। বৈসু উৎসবের প্রথম দিন হারি বৈসু। এই দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে তারা ঘরদোর লেপে , বসতবাড়ি কাপড়চোপড় পরিস্কারপরিচ্ছন্ন করে। ফুল দিয়ে ঘরবাড়ি সাজায়। শিশুরা বাড়ি বাড়ি ফুল বিতরণ করে। তরুণতরুণীরা প্রিয়জনকে ফুল উপহার দেয়। দেবতার নামে নদীতে বা ঝর্ণায় ফুল ছিটিয়ে খুমকামীং পূজা দেওয়া হয়। এদিন মহিলারা বিন্নি চাউলের পিঠা ও চোলাই মদ তৈরি করে।
উৎসবের দ্বিতীয় দিন বিসুমাতে ত্রিপুরারা নববর্ষকে স্বাগত জানায়। ধূপ, চন্দন ও প্রদীপ জ্বেলে পূজা দেয় ও উপাসনা করে। সবাই গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুর বেড়ায়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাচন, সেমাই ও মিষ্টি খায় এবং কলাপিঠা, চুয়ান পিঠা, জাল পিঠা, উন পিঠা ও মায়ুং পিঠা খায়। এছাড়া এদিন তারা নিরামিষ ভোজন করে। কোনো প্রাণি বধ করে না।
অনুষ্ঠানের তৃতীয় দিন আমিষ খাবার গ্রহণে বাধা নেই। এদিনও ফুল দেওয়া হয় ও উপাসনা করা হয়। বয়োজ্যেষ্ঠদের গোসল করিয়ে পায়ের কাছে পূজার নৈবেদ্য হিসেবে ফুল রাখে এবং প্রণাম করে। কেউ কিছু না খেয়ে ফিরে যায়না। সেজন্য সারাদিন ঘরের দরজা খোলা থাকে। এতে গৃহস্থের কল্যাণ হবে বলে মনে করা হয়।
মারমা জনগোষ্ঠীর উৎসবের নাম সাংগ্রাই । প্রতিবছর এপ্রিলের ১৩ থেকে ১৫ তারিখে সাংগ্রাই
পালিত হয়। মারমাদের বর্ষপঞ্জিকাকে “ম্রাইমা সাক্রঃয়” বলা হয়। ম্রাইমা সাক্রঃয়” এর পুরনো বছরের শেষের দুই দিন আর নতুন বছরের প্রথম দিনসহ মোট ৩দিন কে মারমারা সাংগ্রাই হিসেবে পালন করে থাকে। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের সাথে মিল রেখে এপ্রিলের ১৩,১৪ ও ১৫ তারিখে পালন করা হয়।
সাংগ্রাইয়ের প্রথম দিনকে মারমা ভাষায় ‘সাংগ্রাই আক্যা’ বা ‘পাইং দোয়াক’ (সাংগ্রাইয়ের প্রথম দিন পুষ্প আহরণ)। দ্বিতীয় দিনকে ‘সাংগ্রাই বাক্’ (সাংগ্রাইয়ের দিন) এবং তৃতীয় দিনকে ‘সাংগ্রাই আপ্যাইং’ (সাংগ্রাই বিদায়) নামে পরিচিত। এই তিন দিন মারমারা নানা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করে।
মারমা সমাজে নতুন জুম চাষের মৌসুমের শুরুও সাংগ্রাইয়ের পরেই হয়ে থাকে। শুধু জুম চাষই নয় মারমারা মাঘী পূর্ণিমার পর থেকে সাংগ্রাই এর আগ পর্যন্ত নতুন বিয়েই করে না অর্থাৎ সাংগ্রাইকে মারমারা নতুন বছরের শুরুসহ পুরনো সব জিনিসকে ঝেড়ে ফেলে নতুন করে শুরু করাকেই বোঝায়। আর তাই মারমারা এক আনন্দঘন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আর্শীবাদ আর শুভাকাঙ্খার আশায় নতুন বছর উদযাপন করে থাকে। তাছাড়া মারমা যুবকরা তাদের পছন্দের মানুষটির গায়ে পানি ছিটানোর মাধ্যমে সবার সামনে ভালোবাসা প্রকাশ করে। ভালোবাসার এমন বর্ণাঢ্য উচ্ছ্বাস, এমন বর্ণাঢ্য অনুভূতি শুধু এ খেলাতেই সম্ভব।
চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত লোকজনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উত্সব হচ্ছে, “বিজু” বা “বিঝু” উত্সব। চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাগণ এ উৎসবটি ৩দিন ধরে পালন করে থাকে । এ তিন দিন হল চৈত্রের শেষ ২দিন ও বৈশাখের প্রথম দিন। এর মাঝে চৈত্রের শেষ দিনটি এই উৎসবের মূল আকর্ষণ।
চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের উৎসবের
প্রথম দিনটিকে বলা হয়, “ফুল বিঝু “। সেদিন তাঁরা, ঠিক আমরা যেমন, চৈত্র সংক্রান্তির আগে ঘর দোর ঝাড়া মোচা করি, নববর্ষের দিনটির জন্য নতুন কাপড় কিনি, নতুনরূপে শুরু করার প্রস্তুতি নিই, তাঁরা ও ঠিক তেমন করেই প্রস্তুতি নেয়।
দ্বিতীয় দিনটিকে বলা হয়, “মূল বিঝু”। সেদিন তাঁরা সকালে স্নান করে, নতুন কাপড়ে সেজে উঠে, নদীতে কলাপাতায় করে ফুল,পাতা, রান্না করা একটু ভাত, তরকারী ইত্যাদি ভাসিয়ে দেন। সন্ধ্যের দিকে, তাঁদের নৃত্যের অনুষ্ঠান হয়।
তৃতীয় তথা শেষ দিনটিকে তাঁরা বলেন, “গোজ্জে-পোজ্জে দিন”। সেদিন, তাঁরা গান, বাজনা, নৃত্য এসবেই মেতে উঠেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গেল বছর করোনা মহামারির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল উৎসববিহীন।
মাঝখানে করোনার প্রকোপ কমলেও গেলবারের মতো এবারো মার্চের শেষদিকে করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকে অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ দিন দিন বাড়তে থাকায় ৫ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ১১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত সারাদেশে শপিং মল, দোকান-পাট, হোটেল-রেস্তারাঁসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাশাপাশি গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞাসহ
শুরু হয় দেশব্যাপী লকডাউন। আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে আবারো সাত দিনের জন্য ‘কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছেন সরকার। ফলে, অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায় বর্ষবরণ উৎসব। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বছরের সবচেয়ে বড় উৎসব বিজু, সাংগ্রাই ও বৈসাবি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। লকডাউন জনিত আর্থিক লোকসান ও পরপর দুবার উৎসব উদযাপন না করতে পারার মনোবেদনায় মুখের হাসি শুকিয়ে যায় পার্বত্য এ জনপদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষগুলোর। নারী- পুরুষ , ছেলে- মেয়ে, শিশু- কিশোর কারো মুখে হাসি নেই । বৈসাবির উৎসবে মেতে উঠবেনা কোনো পাহাড়ি পাড়া মহল্লা।
ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ভার্চুয়ালি নববর্ষের অনুষ্ঠান করার ঘোষণা এসেছে। সরকারের তরফে বলা হয়েছে , করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে নববর্ষ উদযাপনে কোনোভাবেই জনসমাগম করা যাবে না। স্বল্প পরিসরে ভার্চুয়ালি বা অনলাইনে নববর্ষের অনুষ্ঠান করতে হবে। সবার আগে জনস্বার্থ দেখতে হবে।
মূলত কৃষি কাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন গণনার শুরু হয় মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সন । ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে।
ঐতিহ্যগতভাবে উৎসব প্রিয় তাবৎ বাঙ্গালি প্রতি বছর বর্ষবরণ উৎসব করতে পারলেও গেল বছরের মতো এবারো করোনা মহামারীর কারণে উৎসবে মেতে উঠতে পারছেনা।
সবই স্তব্দ, স্তম্ভিত । মানুষের পৃথিবীতে এখন চলছে অনিশ্চিত সময়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের তাবৎ বাঙ্গালি নীরবেই করোনা মহামারি থেকে সহসা মুক্তির প্রত্যাশা নিয়েই আরেকবার নতুন বছরকে বরণ করে নেবে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই।
চৈত্র সংক্রান্তির মাধ্যমে ১৪২৭ সনকে বিদায় জানিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হবে নতুন বছর ১৪২৮। নতুন বছরের প্রথম ভোরের প্রথম আলো রাঙিয়ে দেবে নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাকে। বুকভরা প্রত্যাশা নিয়ে নতুন উদ্যমে ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতি সোচ্চার হবে নতুন অভীষ্ট অর্জনে। সে স্বপ্ন ও অভীষ্ট হবে, করোনাভাইরাস মুক্ত নতুন বিশ্ব-নতুন বালাদেশ।
মোহাম্মদ কেফায়েত উল্লাহ,
(লেখক ও সাংবাদিক)
অধ্যক্ষ, মাটিরাঙ্গা মহিলা কলেজ ও খাগড়াছড়ি জেলা সংবাদদাতা, দৈনিক সত্যের সকাল।
(বিঃ দ্রঃ সত্যের সকালের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, সত্যের সকাল কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার সত্যের সকাল নিবে না)