► বেনজিন একটি অ্যারোমেটিক যৌগ।
► বেনজিনের সঙ্গে তিন অণু ক্লোরিনের সংযোজনে বেনজিন হেক্সাক্লোরাইড বা গ্যামাক্সিন পাউডার তৈরি হয়, যা জীবাণুনাশক।
► বেনজিনের সঙ্গে ইথিলিনের বিক্রিয়ায় ইথাইল বেনজিন উৎপন্ন হয়।
► বেনজিনের কাঠামোতে একটি H পরমাণু -CH3 দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলে টলুইন তৈরি হয়।
বেনজিন এক প্রকার জৈব যৌগ, যার আণবিক সংকেত C6H6। কখনো কখনো এর সংক্ষিপ্ত Ph-H রূপে লেখা হয়। বেনজিন বর্ণহীন, উচ্চদাহ্য, মিষ্টি গন্ধযুক্ত এবং উচ্চ গলনাঙ্কের তরল পদার্থ। ঔষধ, প্লাস্টিক, কৃত্রিম রাবার ও রঞ্জক প্রস্তুত করতে বেনজিন একটি বাণিজ্যিক দ্রাবক হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
চলুন বেনজিন এর একটি ছোট সাক্ষাৎকার নেয়া যাক::
আমি: মিস্টার বেনজিন সাহেব, প্রথমে আপনি বলবেন, আপনার নাম বেনজিন কেন?
বেনজিন: আমার একটি ষড়ভুজ বলয় আছে। তাই নাম আমার বেনজিন। যদি দুটি বলয় বা চক্র থাকত, তবে নাম হতো ন্যাফথালিন, তিনটি বলয় থাকলে অ্যানথ্রাসিন।
আমি: যতটুকু জানি, আপনি অ্যারোমেটিক যৌগ। বিষয়টা কেমন?
বেনজিন: হুম। ফলমূল ও বিভিন্ন উদ্ভিদের কাণ্ড থেকে যেসব সুগন্ধি আপনারা পান, সেগুলো অ্যারোমেটিক যৌগ। একে অ্যারিন বলেও ডাকা হয়।
আমি: আপনার মতো দেখতে তোহ আরো অনেক চাক্রিক যৌগ রয়েছে তাদের মধ্যে থেকে আপনাকে বা অ্যারোমেটিক যৌগগুলোকে চিনবো কি করে?
বেনজিন: আমাকে চিনতে হলে আপনাকে বেশকিছু শর্ত জানতে হবে।তবে সবচেয়ে ভালো হয়, আপনি যদি হাকেল তত্ত্ব প্রয়োগ করতে জানেন।হাকেল তত্ত্বটি হলো 4n+2
আমি: ল্যাবে আপনাকে কিভাবে প্রস্তুত করা যায়?
বেনজিন: অনেক উপায়েই আমাকে প্রস্তুত করা যায়।তবে সবচেয়ে সহজ উপায় হলো, আপনি যদি অ্যাসিটিলিন গ্যাসকে ৪৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপে উত্তপ্ত লৌহ নলের মধ্যে আমাকে চালনা করতে পারেন।তাহলেই আমাকে পেয়ে যাবেন।
আমি: আপনার পরিবারে কে কে আছে?
বেনজিন: নাম বলে শেষ করা যাবে না।আমার বলয়ে একটি হাইড্রোজেন পরমাণু যখন কোনো মূলক দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, তখন তা নতুন যৌগে পরিণত হয় এবং তাদের ভিন্ন নামে ডাকা হয়।
যেমন—আমার বলয়ে একটি H পরমাণু -CH3 দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলে টলুইন, -OH দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলে ফেনল, -NH2 দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলে অ্যানিলিন, -COOH দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলে তাকে বেনজয়িক এসিড বলে।
আমি: অহংকারী যৌগ হিসেবে আপনার বেশ দুর্নাম আছে,আপনি নাকি নির্দিষ্ট কিছু বিক্রিয়া ছাড়া অন্যান্য বিক্রিয়া দিতে চান না?বিষয়টা একটু খোলাসা করবেন প্লীজ?
বেনজিন: যারা এই দুর্নামগুলো করে তাদের আমার গঠন সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না।তাদের মনে রাখা উচিত যে আমি একটি চাক্রিক যৌগ।কাজেই আমার চক্র নষ্ট হয়ে যায় এমন বিক্রিয়া তো আমার মন দিতে চাইলেও আমি দিতে পারবো না। তাই আমি বেশিরভাগক্ষেত্রে ইলেকট্রনাকর্ষী প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া(হ্যালোজেনেশন,নাইট্রেশন,সালফোনেশন) দিয়ে থাকি।তাছাড়া অনেকসময় অনেকের অনুরোধে ও বিশেষ শর্তে যুত বিক্রিয়াও দেই।
আমি: ব্যক্তিগতভাবে কাউকে পছন্দ করেন?
বেনজিন: জ্বী। O, —NH₂, —OH, OCH₃, হ্যালোজেন, এদের পছন্দ করি।.
আমি: এদের পছন্দ করার রহস্য কী?
বেনজিন: আসলে ইলেকট্রনের প্রতি আমার সবসময়ই দুর্বলতা কাজ করে, অতিরিক্ত কিছু ইলেকট্রন পেলে আমার সক্রিয়তা ও স্থায়িত্ব উভয়ই বৃদ্ধি পায়।আর ওদের প্রত্যেকেরই মুক্তজোড় ইলেকট্রন রয়েছে,তাই আর কি……
আমি: থাক আর বলতে হবে না। অপছন্দেরও কেউ আছে নাকি আপনার?
বেনজিন: পছন্দ অপছন্দ মিলেই একটি যৌগের জীবন।—NO₂, —CN, —COOH, —COOR ইত্যাদি কে আমি খুবই অপছন্দ করি।
আমি: এদের অপছন্দ করার কারণ কী?
বেনজিন: কারণ হলো এরা আমার কাছে এলেই আমার ইলেকট্রন টেনে নেয়,এতে আমার অস্তিত্ব ও সক্রিয়তা হুমকির মুখে পড়ে যায়।তাই এদেরকে আমার শত্রুও বলতে পারেন।
আমি: আমরা আপনাকে শত্রুর হাত থেকে প্রটেকশন দিতে চাই।আমরা আপনার শত্রুগুলোকে সহজে চিনবো কীভাবে?
বেনজিন: এরা প্রত্যেকেই দ্বিবন্ধন বা ত্রিবন্ধনে যুক্ত থাকে। যেমন- N=O (NO₂), O=C-OH (COOH), O=C-OR(COOR)
তবে খেয়াল রাখবেন, আমার শত্রু মনে করে আবার আমার পছন্দের তালিকার কারো ক্ষতি করবেন না।তাদের চিনার টেকনিক হলো তারা প্রত্যেকেই এক বন্ধনে যুক্ত থাকে।যেমন —Cl,—Br, H-N-H বা N-H-H (NH₂) ইত্যাদি।
আমি: মানবজীবনে আপনার ভূমিকা কি?
বেনজিন: অনেক।যেমন ধরুন আমি নিজে গ্যামাক্সিন হয়ে জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে করি।এছাড়া আমার পরিবারের অনেক সদস্যদের ব্যবহার করে প্যারাসিট্যামল সহ আরো বিভিন্ন ঔষধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
এছাড়া অ্যালকাইল বেনজিন সালফোনেটসমূহ ডিটারজেন্ট প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়।
আমি: কারো ক্ষতি করেন?
বেনজিন: কারো ক্ষতি করার ইচ্ছা আমার নেই। তবে আমার পরিবারের সদস্য টলুইন একটু রগচটা টাইপের। তাকে টিএনটি বানিয়ে বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটা অবশ্য মানুষের উপকারের জন্যই আবিষ্কার করা হয়েছিল।
আমিঃ বর্তমানে আপনাকে নাকি ক্যান্সারের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে? এটা কি সত্যি?
বেনজিন: জ্বী সত্যি।
আমি: তাহলে বিষয়টা এড়িয়ে গেলেন যে?
বেনজিন: আপনাদের এই একটা সমস্যা, আমার দ্বারা এতো উপকার পান সেসব নিয়ে কোনো মাতামাতি নেই, আর যেই একটি খুত পেলেন অমনি শুরু করে দিলেন। আরে ভাই যেকোনো রাসায়নিক মৌল কিংবা যৌগের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকবে,এটাই স্বাভাবিক।এসব কিছু এড়াতে একটু সাবধান থাকলেই হয়।
আমি: I am sorry মিস্টার বেনজিন। যাইহোক, ঐ যে টিএনটি এর কথা বললেন সেটা বানায় কী করে?
বেনজিন: দুই উপায়ে বানানো যায়।সবচেয়ে সহজ উপায় হলো– যদি ধূমায়মান নাইট্রিক এসিড ও ধূমায়মান সালফিউরিক এসিডের মিশ্রণ দ্বারা টলুইনের নাইট্রেশন ঘটান,তাহলে সরাসরি TNT তৈরি হয়ে যাবে।
আমি: প্রায় সময় TNT এবং TNB এর মধ্যে তালগোল পাকিয়ে যায়।এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী?
বেনজিন: TNT এবং TNB দুটোই তৈরি হয় নাইট্রেশন বিক্রিয়া দ্বারা।আপনাকে শুধু মনে রাখতে হবে TNT আসে টলুইন থেকে আর TNB আসে নাইট্রোবেনজিন থেকে,তাহলেই আসা করি আর তালগোল পাকাবে না।
আমি: আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার কোনটি বলে মনে করেন?
বেনজিন: স্টাইরিন।যা থেকে পলিস্টাইরিন এবং কৃত্রিম রাবার তৈরি করা হয়।
আমি: পলিস্টাইরিন কীভাবে তৈরি হয়? এবং এটি কি কাজে লাগে?
বেনজিন: শুষ্ক অ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইডের প্রভাবকের উপস্থিতিতে আমার সঙ্গে ইথিলিনের বিক্রিয়ায় ইথাইল বেনজিন উৎপন্ন হয়। একে নির্ধারিত তাপমাত্রায় ফেরিক অক্সাইডের প্রভাবকের ওপর চালনা করে স্ট্যারিন উৎপন্ন হয়। আর স্ট্যারিন থেকে উচ্চ চাপ সংযোজন পলিমারকরণ প্রক্রিয়ায় পলিস্টারিন তৈরি হয়।
এগুলো প্লাস্টিক তৈরির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমি: মিঃ বেনজিন।আমরা প্রায় সাক্ষাৎকারের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি।সবশেষে, রসায়নের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আপনার কিছু বলার আছে?
বেনজিন: আমি শুনেছি কিছু শিক্ষার্থী নাকি আমাকে কঠিন মনে করে অধ্যয়ন করতে ভয় পাই।তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, আমি খুবই সহজ এবং আমাকে আয়ত্ত করাও সহজ,তারা যেন আমাকে কঠিন মনে করে ভয় না পায়।আর পাশাপাশি রসয়ানের শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে তারা যেন আমাকে নিয়ে গবেষণা অব্যাহত রাখে।তাহলে হয়তো আমি মানব কল্যাণে আরো কিছু অবদান রাখতে পারবো।
আমি: অসংখ্য ধন্যবাদ মিঃ বেনজিন, আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য।
বেনজিন: You are welcome.
লেখক: মো: আবির হোসেন।
সংগ্রহ: অমিত পাল।