গত এক বছর যাবৎ সারাদেশে করোনা সংক্রমণ ক্রমান্বয়ে চলছে। সম্প্রতি করোনা সংক্রমন ও মৃত্যুর হার বাড়তে থাকায় গত ৫ এপ্রিল থেকে প্রথম ধাপে কঠোর বিধিনিষেধ ও লকডাউন জারি করা হয়। মৃত্যুর হার বৃদ্ধ ও পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে তাই পূনঃরায় দ্বিতীয় ধাপে ১৪ এপ্রিল থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি করে কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছেন সরকার। এই দীর্ঘ মেয়াদী লকডাউনের কারনে বিপাকে পরেছেনে সাধারণ, মধ্যবিত্ত, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ও নিম্ন আয়ের মানুষ। সাধারণ ও মধ্যবিত্ত মানুষ কোন রকম টানাটানি করে চলছেন আর ক্ষুদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের তিন বেলা দু্-মুঠ ভাত যোগার করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
অন্যদিকে গত লকডাউনের কারনে অর্থ সংকটের প্রভাব ঠিকমতো কাটিয়ে ওঠার আগেই পূনঃরায় লকডাউনের কারনে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পরেছেন ক্ষুদ্র ও মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীরা। আর নিম্ন আয়ের মানুষ সার্বিকভাবে ভয়াবহ সংকটে পরেছেন।
লকডাউনে পড়ে সৃষ্ট দুর্ভোগ-কষ্টের কথা খুলনা মহানগরীর নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে জানা যায়। কেউ বলেছেন চরম অর্থকষ্টের কথা, কেউ বলেছেন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা। কেউ আবার স্বপ্ন সাজানোর পথে হোঁচট খাওয়ার কথা বলতে গিয়ে হয়েছেন আবেগতাড়িত।




রোজা থেকে সারাদিন ঘুরে ঘুরে রিকশা চালিয়ে যা পাইছি তা দিয়ে কিছু হবে না” স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে সহ সংসারে ৪ জন সদস্য নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন রহমত আলী। তিনি একজন রিক্সা চালক প্রতিদিন রোজগার করলে একটু ভাত জুটবে।
তিনি বলেন, লকডাউন আসাতে এখন তেমন একটা ভাড়া পাইনা তারপর পুলিশের দাবরানি তো আছেই। রিক্সা নিয়ে বের হলেই পুলিশ বলে বাইরে বেরহইছো কে জানোনা লকডাউন তারপর প্যাসেঞ্জার নামায়ে দেয়। বাহিরে না বের হলে আমরা খাবো কি? পুলিশের ভয়ে মেইন রোডে যাইনা অলিতে গলিতে রিক্সা চালাই। তারপর মানুষ এখন খুব বেশি একটা বের হয়না তাই ভাড়া পাইনা তেমন। রোজা থেকে সারাদিন ঘুরে ঘুরে রিকশা চালিয়ে যা পাইছি তা দিয়ে কিছু হবে না। বাড়ি আমার বৌ ছেলে মেয়ে আছে তাদের মুখে দুই ডা ভাত তুলে দিতে হবে। এই কয়ডা টাকায় কি হবে। আমাদের তো আর কিছু নাই। রিক্সা চললে খাবার আছে আর না চললে সে দিন খাবার নাই।




বেচাকেনা না হলে সংসার চালাবো কিরে ” খুলনা রেলস্টেশনের গেটের পাশে একজন ভ্রাম্যমাণ চা সিগারেট বিক্রেতা ময়না বেগম। চার সন্তানের জননী তিনি, বাড়িতে তার অসুস্থ স্বামী আছেন।
তিনি বলেন, আমার স্বামী পাগল কাজ করতে পারেনা আর বড় ছেলেটা কাজে গিয়ে হাত ভেঙ্গে গেছে সেও তেমন কিছু করতে পারেনা। বাকি ছেলে মেয়েরা এখনো ছোট পরিবারে একমাত্র উপার্জন করি আমি। আগে সারাদিন চা সিগারেট বিক্রি করে আমার সংসার মটামুটি চলতো। এখন লকডাউন আসাতে বেচাকেনা নাই। আগে রাত বারোটা পর্যন্ত কেনাবেচা করছি এখন আটটা ও বাজতে পারেনা পুলিশ এসে উঠায়ে দেয়। অন্য যায়গায় গিয়ে বসলেও এক অবস্থা হয়। কোথাও গিয়ে বসতে পারিনা পুলিশ উঠায়ে দেয়। সারাদিনে তেমন কিছু বেচতে পারিনি এখন বেচাকেনা না হলে সংসার চালাবো কিরে?




“সব যায়গা বন্ধ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো” নগরীর লঞ্চঘাটের একজন সরবত বিক্রেতা আবুল হাসান। ৪নং ঘাট সংলগ্ন এলাকায় তার বাড়ি। তিনি ও বললেন তার কষ্টের কথা। আগে ৭নং ঘাটে সবাই ঘুরতে আসতো আমি ওখানে রোজ যাইতাম ভালো বেচাকেনা হইতো, এখন লকডাউনের কারনে লোকজন আর আগের মত আসেনা। তারপর পুলিশ ওইখানেও এখন দাঁড়াতে দেয়না। আর এদিকে মার্কেট বন্ধ সেখানেও যেতে পারছিনা।
বললাম মার্কেট তো বন্ধ সামনে ঈদ, দোকান মালিকেরাও তো কেনাবেচা করতে পারছেনা। তিনি বললেন, ওনাদের তো অনেক আছে আমাদের তো কিছুই নাই। সব যায়গা বন্ধ থাকলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো? “




পাওয়ার হাউস মোড়ের সামনে দিনমজুর শাহানারা বানুকে উদাস ভাবে বসে থাকতে দেখা যায়। তিনি জানান চক্রাখালী থেকে তিনি এসেছেন একটা কাজের আশায়। রাজমিস্ত্রির জোগাল হিসাবে খাটতাম। দিন শেষে ৪০০ ডা টাকা পাইতাম। এখন তো তা আর হয়না, সারাদিন বসে আছি একটা কাজের আশায়। লকডাউনে সব কাজ বন্ধ। সব বন্ধ থাকলে আমরা খাবো কি?




শিববাড়ি মোড়ের বেকারি ও ইফতার বিক্রেতা বাবা লিটন সাহা ও ছেলে অরোবিন্দু সাহা। বাবা লিটন সাহা বললেন লকডাউনের আগে অফিস আদালত , পাশের শোরুম, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলো খোলা থাকলে আমার বেকারিতে ভালো কেনাবেচা হতো। বর্তমানে সব বন্ধ থাকায় বেকারির খাবার রাখা বন্ধ করে দিয়েছেন। কোন রকম দোকানের একটা ধাপ খুলে রেখেছেন। তিনি বলেন পুলিশ দেখলেই দোকানের ধাপ বন্ধ করে দেই। আবার চলে গেলে পর্বতিতে একটু খুলি। এভাবেই চলছে পুরো লকডাউন ধরে।
ছেলে আরোবিন্দু সাহা বলেন, সারাদিনে বেচাকেনা নাই শুধুমাত্র ইফতারের সময় একটু যা হয়। তারপর সাতটার মধ্যে বন্ধ করে দিতে হয়। দোকান ভাড়া উঠছে শুধু আর যা থাকে তা অতি সামান্য এভাবে কষ্ট করে কত দিন থাকতে হবে কে জানে ?




লকডাউনের কারনে বেশিরভাগ মানুষ হয়ে পরেছেন কর্মহীন। ভবঘুরের মতো এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে মানুষ। এরই সাথে বেড়ে গেছে ভিক্ষাবৃত্তি। মানুষ ভিক্ষার আসায়ে পথচারীদের পেছনে ছুটে বেড়াছে দেখা মাত্রই।
তেমনি একজন ভবঘুরে মোসাঃ রোজিনা সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ান একটু সাহায্যের আশায়। নয়তো কোন হোটেল থেকে খাবার চেয়ে খাই। তিনি বলেন বেশির ভাগ হোটেল বন্ধ আছে আর আগে মত রাত হলে আর খাবার দিতে কেউ আসেনা তেমন একটা। তিনি বলেন সারাদিন কিছু খাইনি। খুধায় মাথা ঘুরায়।




গল্লামারীতে আঁখের রস বিক্রেতা অল্পবয়সী এক যুবক মোঃ আল আমিন। বৃদ্ধ বাবা মায়ের মেজো সন্তান। বড় বোন থাকে শশুর বাড়ি আর ছোট ভাই বোনেরা লেখা পড়া করে। সংসারের যোয়াল এখন তার কাঁধে। সে ও জানালো তার কথা, আগে বিকাল থেকে রাত ১০টা-১১টা পর্যন্ত এই মেশিন চালিয়ে আঁখের রস বিক্রি করছি। এখন তো মোড়ে দাঁড়াতে পারিনা পুলিশ এসে চলে যেতে বলে, তাই এখন অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াই দুটো রোজগারের আশায়। মেশিন চললে তেবই তো সংসার চলবে।
গত লকডাউনের এর সময় সরকারি ও বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে সকলে মিলে হতদরিদ্রদের মধ্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেও এবছর তেমন কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। হতদরিদ্ররা সরকারের কাছ থেকে তেমন কোন সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলেও তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে।
দৈনিক সত্যের সকাল / ফারিয়া ডায়না পিংকি ও আহাদ শিকদার (খুলনা সদর)