তানজির রহমান : ভোরের বিন্দু বিন্দু শিশির তখন হলুদ ফুলের শরীরজুড়ে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তার মতো ঝিকমিকে শিশির কণা গড়িয়ে নামে। সকালের রোদে ঝলমল করতে থাকে মাঠভর্তি হলুদ সরিষা ফুল। যতদূর চোখ যায় কেবল হলুদ আর হলুদ। যেন সবুজ মাঠজুড়ে আগুন লেগেছে! ধীরে ধীরে বেলা গড়িয়ে নামে বিকেল। বিকেলের ‘কন্যাসুন্দর’ আলোয় হলুদ ফুলগুলোর রূপ যেন আরেকটু খোলে। মিষ্টি বাতাসে দুলে দুলে ওঠে ফুলের ডগা। ফিরে আসতে শুরু করে শিশিরের দল। জমিয়ে বসে ফুলে।
সরিষা বা সরষে ব্রাসিকা (Brassica) বা ক্রুসিফেরি (Cruciferae) গোত্রের কয়েক প্রজাতির তেল প্রদায়ী দ্বিবীদপত্রী উদ্ভিদ ।এর ডিম্বক বক্রমুখী ৷ সরিষার দানা মশলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও সরিষার দানা পানির সাথে মিশিয়ে ভিনেগার সহ বিভিন্ন তরল তৈরি করা হয়, দানা পিষে সরিষার তেল তৈরি করা হয় যা রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়। সরিষার পাতা সরিষার শাক বা সর্ষে শাক হিসেবে খাওয়া হয়। বাংলা মানুষের সাথে সরিষার যেন এক মায়াবী সম্পর্ক।
শীতের রিক্ততায় রং ও প্রাণের স্পন্দন নিয়ে আসে সরিষা ফুল। দিগন্ত বিস্তৃত হলুদ সরিষা ফুলে সেজে উঠেছে প্রকৃতি। নাগরিক জীবনে হাঁপিয়ে উঠলে একটু সময় করে হলুদের রাজ্য থেকে ঘুরে আসতে পারেন। সরিষা ফুলের হলদে সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই।প্রকৃতিতে যেন বসন্ত লেগেছে। অথচ এখন শীতকাল। ধুলা আর কুয়াশায় ধূসর প্রান্তর। তাও দূর থেকে হলুদ আভার আহ্বান। চারদিকে হলুদের সমাহার। এ যেন রূপকথার রাজকুমারীর গায়ে হলুদ। সবাই কনেকে হলুদ দিতে এসেছেন। এসেছে প্রজাপতি, মৌমাছি, হলুদিয়া-নীলরঙা পাখি, পোকামাকড় থেকে শুরু করে রাজ্যের প্রজারা।
সবাই যেন হুমড়ে পড়ছে হলুদের ওপর।তার সেকি ঝাঁজালো ঘ্রাণ। শীতের বাতাসে ঘ্রাণও তেমন পাওয়া যায় না। বেশির ভাগ ফুলে এ সময় গন্ধ থাকে না সরিষা ব্যতিরেকে। এ ঝাঁজ যেন বুকে ধাক্কা মারে। বিজ্ঞানীরা একে বায়ু বিশুদ্ধকরণ ঘ্রাণ বলে বিবেচনা করেন।
ফুসফুসের উপকার সাধিত হয় সরিষা ফুলের ঘ্রাণে। তাই শীতে বসে না থেকে প্রান্তরের হলুদে মিশে যান একদিন। সেখানে সবাই ব্যস্ত। কেউ কারো দিকে তাকানোর সময় নাই। কৃষকরা ব্যস্ত সরিষা তুলতে, ভ্রমর মধু খুঁজে ফিরছে ফুলে ফুলে।
দেখবেন নানা রঙের প্রজাপতিতে ভরে আছে সরিষা ক্ষেত। রঙ-বেরঙের প্রজাপতি ডানা ঝাপটানো চিত্তে জাগাবে নবতর আনন্দ। কোথাও ঝলক দিয়ে উঠছে কালো ডানায় হলুদ-লালের মিশ্রণ, নীল, সবুজ, লাল-নীলের ডোরাকাটা বিভিন্ন রঙের প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। প্রজাপতিরা এখানে আসে বিশ্রাম নিতে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সরিষার ঝাঁজে তাদেরও উপকার মেলে। অনেক দূর উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ানোর পর সরিষার মাদকতা তাদের আকৃষ্ট করে।
এসে জিরিয়ে নেয় খানিকটা কোনো ফুলের অথবা পাতার গোড়ায়। আর সেখানেই ঘটে বিপত্তি। প্রজাপতি খাদকরা এর মধ্যেই হাজির হয়ে গেছে আশপাশে। ঘাপটি মেরে আছে কখন ঠোকর মেরে তুলে নিয়ে যাবে রঙিন ডানার প্রজাপতি। ফিঙে, শালিক- এমন অনেক শিকারি পাখির জন্যও যেন উত্সব। অঢেল প্রজাপতি আজ তাদের খাবার হিসেবে উড়ে বেড়াচ্ছে নাগালের মধ্যেই।
শুধু প্রজাপতি কেন আরো অনেক নাম না জানা পোকার বসত সরিষা ক্ষেতজুড়ে। আশ্চর্য সব পোকামাকড়ের দেখা মিলবে। কোনটা হলুদ, কোনটা লাল। পিঁপড়ারাও দলবেঁধে সরিষা ক্ষেতে ফুল তুলতে এসে হাজির। এ যেন এক ঈশপের গল্প। এ সময় ফুল ও ভ্রমরের রূপকথার সন্ধানে হেঁটে বেড়াতে পারেন সরিষা ক্ষেতের আইল ধরে; প্রকৃতির জীবনের অনেক গোপন মুহূর্তের সন্ধান পেয়ে যাবেন হয়তো।
সরিষা ক্ষেতের মাঝে দাঁড়ালে তার ঘ্রাণ আপনাকে মুগ্ধ করে দিবে আর দিনের বেলায় সরিষা ক্ষেতে প্রচুর অক্সিজেন থাকে। মিষ্টি গন্ধ ভুলিয়ে দিবে শহুরে জীবনযাপনের বিরক্তি।
ভ্রমনের সময় মনে রাখবেন
আপনার কোনও কাজে সরিষা ক্ষেত যেন নষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ রাখবেন। অনেকেই ছবি তোলার জন্য সরিষা ফুল মাড়িয়ে নষ্ট করেন।
খুব বেশি মানুষ একসঙ্গে সরিষা ক্ষেতে না যাওয়াই ভালো। এতে অরিতিক্ত হইচই হয় যা স্থানীয় বা মাঠে যারা কাজ করেন তাদের জন্য বিরক্তির কারণ হতে পারে।
চিপসের প্যাকেট অথবা অপচনশীল কিছু ফেলে আসবেন না।