নিজেদের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে ইতি টেনে সম্প্রতি আফগানিস্তান ছেড়েছে মার্কিন বাহিনী। ফলে বিনা বাধায় দেশটির ক্ষমতা দখল করে তালেবান, নতুন করে শুরু হয় শরণার্থীর স্রোত। টানা দুই দশক আফগানিস্তানে কথিত শান্তিপ্রতিষ্ঠার যুদ্ধে কী মূল্য চুকাতে হয়েছে, আফগান ও মার্কিনিদের কাছে সম্প্রতি এমন প্রশ্ন রেখেছিল রুশ টেলিভিশন নেটওয়ার্ক আরটি। জবাবে তারা জানিয়েছেন, কতটা ভয়ংকর পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে তাদের, যার ফল ভুগতে হচ্ছে আজও।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলা চালায় আল-কায়েদা। এতে প্রাণ হারায় প্রায় তিন হাজার মানুষ। হামলাকারী জঙ্গিগোষ্ঠীর নেতা ওসামা বিন লাদেনকে তালেবান আশ্রয় দিয়েছে অভিযোগ তুলে ওই বছরই আফগানিস্তান আক্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও পরে পাকিস্তানে পাওয়া যায় লাদেনকে, সেখানেই মার্কিন বাহিনীর হামলায় প্রাণ হারান এ জঙ্গি নেতা। এরপরও আফগানিস্তান ছাড়েনি যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে পাল্টা বিদ্রোহ, বিমান হামলা আর স্থানীয় যুদ্ধনেতাদের অর্থ সাহায্যের মাধ্যমে কথিত ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার মিশন চালিয়ে গেছে মার্কিন প্রশাসন।
যুক্তরাষ্ট্রের হেরে যাওয়া এ যুদ্ধে অংশ নেওয়া সাবেক সেনা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা, তালেবানের পক্ষে-বিপক্ষে লড়া আফগান এবং এ সহিংসতার মধ্যে পড়া সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলে ‘আফগানিস্তান আফটার দ্য ইউএস’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছে আরটি। গত শুক্রবার (১০ সেপ্টেম্বর) প্রচার করা হয়েছে সেটি।
আরটির তথ্যমতে, ২০০৫ সালে মার্কিন সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন ব্র্যান্ডন। তিনি বলেন, আমি নায়ক হতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম মানুষকে সাহায্য করবো, ভালো কিছু করবো। কিন্তু এর বদলে ড্রোন চালিয়ে এক নিষ্পাপ শিশুর হত্যাকারী হয়ে ওঠেন তিনি, যা আজও তার বুকে ‘ছুরির মতো’ বিঁধে রয়েছে।
ড্রোন দিয়ে মানুষ হত্যা প্রসঙ্গে ব্র্যান্ডন বলেন, শুধু লক্ষ্যবস্তু ঠিক করো আর মারো! বিষয়টি এত সোজা, যে কেউই তা করতে পারবে। তার কথায়, শিশুদের কুকুর হিসেবে লেখা হতো। নিরপরাধ মানুষদের লেখা হতো ‘কোলাটেরাল ড্যামেজ’ (সমান্তরাল ক্ষতি)। তারা শুধু বইয়ের হিসাবে একটি সংখ্যা মাত্র।
কিছু আফগান অবশ্য ভেবেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে উন্নতি করবে আফগানিস্তান। কিন্তু শিগগির তাদের সেই ভুল ভাঙে। জেলাল উদ্দিন শিনওয়ারি নামে তালেবানের এক সাবেক বিচারক বলেন, জনগণ দ্রুতই প্রকৃত মর্ম এবং মার্কিন গণতন্ত্রের মূল্য বুঝতে পেরেছিল।
তালেবানবিরোধী যোদ্ধা মোহাম্মদ আমিন অভিযোগ করেন, মার্কিনিরাই আফগান সশস্ত্র গোষ্ঠীটি টিকিয়ে রেখেছিল। তার মতে, অন্ধকার ও অজ্ঞ শক্তির সাহায্যে আফগান জনগণকে শাসন করা চালিয়ে যেতেই তালেবানকে লাইফ সাপোর্টে বাঁচিয়ে রাখে যুক্তরাষ্ট্র।
তালেবানের সাবেক কমান্ডার সৈয়দ মোহাম্মদ আকবর আগারের দাবি, গত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা আফগানিস্তানে কিছুই নির্মাণ করেনি। তিনি বলেন, (সাবেক) সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের জন্য অনেক কিছু বানিয়েছিল, যার অনেক স্থাপনা আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কিছুই বানায়নি।
গত দুই দশক পশ্চিমা বাহিনীকে সহায়তাকারী আফগানদের একটি অংশ এরই মধ্যে কাবুল ছেড়েছে। এখনো আটকা রয়েছেন এ ধরনের হাজার হাজার মানুষ। গত তিন সপ্তাহে যত আফগান দেশত্যাগ করেছেন, তাদের বেশিরভাগই সাধারণ নাগরিক, যারা পশ্চিমা বিশ্বে উন্নত জীবন পাওয়ার আশায় গেছেন। বাকিরা যুদ্ধের কারণে বাস্তুচ্যুত, যাদের পালানোর কোনো বিকল্প ছিল না বললেই চলে।
আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরিফের বাইরে মরুভূমির মধ্যে একটি শরণার্থী শিবিরে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় ফারিয়াব প্রদেশ থেকে পালিয়ে আসা আলিমা নামে এক শরণার্থীর। তিনি বলেন, আমাদের চারপাশে যুদ্ধ চলছিল। হয় তালেবান গুলি করছিল, না হয় অন্য কোনো বাহিনী। আমাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। আমার এক বোন (বিমান হামলায়) শহীদ হয়। আরেক বোন ট্যাংকের গোলায় প্রাণ হারায়। এখানে পালিয়ে আসার আগে এভাবেই আমরা ঘুরে বেরিয়েছি আর কষ্ট পেয়েছি।
আরটির প্রমাণ্যচিত্রে উঠে আসে আফগানিস্তানে আফিম চাষ ও এতে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের বিষয়টিও। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সাবেক কর্মকর্তা জন কিরিয়াকু ২০০৯ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকে আফগানিস্তানে আফিম চাষের বিষয়ে সতর্ক করেন। কিন্তু জবাবে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি তাকে বলেছিলেন, এর পুরোটাই ইরান ও রাশিয়ায় যায়। তারা হেরোইনে আসক্ত কি না তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না।